আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লার অস্তিত্বের প্রমাণ

আল্লাহ্‌ তাআলা’র অস্তিত্ব ইসলামিক বিশ্বাসের মূল ভিত্তি এবং এটি কুরআন এবং হাদীসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলির মধ্যে একটি। নিচে কুরআন এবং বুদ্ধির মাধ্যমে আল্লাহ্‌ তাআলা’র অস্তিত্বের প্রমাণ দেয়া হলো:

১. কুরআনী প্রমাণ:

কুরআনে আল্লাহ্‌ তাআলা’র অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায় অনেক আয়াতে, যেমন:

সৃষ্টি আয়াত:
“اللَّهُ خَالِقُ كُلِّ شَيْءٍ وَهُوَ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ وَكِيلٌ” (যুমার: ৬২)।
এই আয়াতটি প্রমাণ করে যে আল্লাহ্‌ তাআলা সব কিছু সৃষ্টি করেছেন, এবং এটাই তার অস্তিত্বের প্রমাণ।

বিশ্বের সৃজনশীলতা:
“أَمْ خُلِقُوا مِنْ غَيْرِ شَيْءٍ أَمْ هُمُ الْخَارِجُونَ مِنْ غَيْرِ شَيْءٍ” (তুর: ৩৫)।
এই আয়াতে বলা হয়েছে, পৃথিবী বা মহাবিশ্ব কোনো সৃষ্টির দ্বারা সৃষ্টি হয়নি, তার জন্য অবশ্যই একটি স্রষ্টা থাকতে হবে—এটি আল্লাহ্‌ তাআলা’র অস্তিত্বকে প্রতিষ্ঠিত করে।

মৃত্যুর পর পুনর্জন্ম:
“وَالَّذِي أَحْيَا هَذِهِ الْأَرْضَ بَعْدَ مَوْتِهَا” (রূম: ১৯)।
এই আয়াত থেকে বোঝা যায় যে আল্লাহ্‌ তাআলা মৃত্যুর পর জীবিত করতে পারেন, যা তার অসীম ক্ষমতার প্রমাণ।

বৈশ্বিক প্রকৃতির প্রমাণ:
“إِنَّ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاخْتِلَافِ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ لَآيَاتٍ لِّي أُولِي الْأَلْبَابِ” (আল-ইমরান: ১৯০)।
এই আয়াতটি বলে যে পৃথিবী ও আকাশের সৃষ্টি এবং দিনের রাতের পরিবর্তন আল্লাহ্‌ তাআলা’র অস্তিত্বের প্রমাণ।

২. বুদ্ধিমূলক প্রমাণ:

আল্লাহ্‌ তাআলা’র অস্তিত্ব বুদ্ধি ও চিন্তা দ্বারা প্রমাণ করা যায়, যেমন:

বৈশ্বিক শৃঙ্খলা:
পৃথিবীতে যে নিখুঁত শৃঙ্খলা ও সুসংগতি আছে—যেমন গ্রহের আন্দোলন, পৃথিবীতে জীবন এবং প্রাকৃতিক আইন—এগুলি প্রমাণ করে যে এর পেছনে একজন মহান স্রষ্টা আছেন।

কারণ এবং ফল:
প্রতিটি ঘটনা বা কিছুর একটি কারণ থাকে। এই কারণে, যা কিছু সৃষ্টি হয়েছে, তার পেছনে অবশ্যই এক প্রাথমিক কারণ (স্রষ্টা) থাকা উচিত—এটাই আল্লাহ্‌ তাআলা’র অস্তিত্বের প্রমাণ।

প্রকৃতির মধ্যে সৃষ্টির প্রবৃত্তি:
মানুষ প্রকৃতিগতভাবে আল্লাহ্‌ তাআলা’র অস্তিত্বে বিশ্বাসী। মানুষের অন্তর্নিহিত প্রকৃতি তাকে আল্লাহ্‌ তাআলা’র অস্তিত্বের দিকে পরিচালিত করে।

৩. মহাবিশ্বের শৃঙ্খলিত প্রকৃতি:

বৈশ্বিক শৃঙ্খলা, প্রকৃতির আইন এবং জীবন্ত সত্ত্বাগুলির জটিলতা প্রমাণ করে যে এটি কোন অপ্রত্যাশিত ঘটনা নয়, বরং এর পেছনে একটি শৃঙ্খলিত স্রষ্টা রয়েছে—এটি আল্লাহ্‌ তাআলা’র অস্তিত্বের আরেকটি প্রমাণ।

আল্লাহ্‌ তাআলা’র একত্ব (তাওহীদ):

তাওহীদ হচ্ছে ইসলামিক আকীদার মূল ভিত্তি। এটি আল্লাহ্‌ তাআলা’র একত্ব ও এককত্বকে বিশ্বাস করা, তার সৃষ্টির মধ্যে কোনো শরিক না রাখার প্রতিশ্রুতি। তাওহীদ তিনটি ভাগে বিভক্ত:

  1. তাওহীদ রুবুবিয়াহ:
    আল্লাহ্‌ তাআলা’র একত্ব বিশ্বাস করা সৃষ্টির, রিজিকের, এবং পৃথিবী পরিচালনার ক্ষেত্রে।
    কুরআনি প্রমাণ: “اللَّهُ خَالِقُ كُلِّ شَيْءٍ وَهُوَ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ وَكِيلٌ” (যুমার: ৬২)
  2. তাওহীদ উলুহিয়াহ:
    আল্লাহ্‌ তাআলা’র একমাত্র উপাস্য হওয়া।
    কুরআনি প্রমাণ: “وَقَضى رَبُّكَ أَلّا تَعبُدوا إِلّا إِيّاهُ وَبِالوالِدَينِ إِحسانًا…” (ইসরা: ২৩)
  3. তাওহীদ আসমা ওয়া সিফাত:
    আল্লাহ্‌ তাআলা’র অসীম নাম ও গুণাবলী বিশ্বাস করা, যেমন কুরআন এবং হাদীসে এসেছে।
    কুরআনি প্রমাণ: “لِلَّهِ الْأَسْمَاءُ الْحُسْنَىٰ فَادْعُوهُ بِهَا…” (আরাফ: ১৮০)

তাওহীদের গুরুত্ব:

ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস: তাওহীদ হলো ইসলামিক বিশ্বাসের প্রথম স্তম্ভ।

জান্নাতের চাবি: তাওহীদে বিশ্বাস করা জান্নাতে প্রবেশের উপকারি পথ।
হাদীস: “যে বলবে ‘লাহ্‌ ইলাহ্‌ ইল্লাল্লাহ’, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।” (বুখারি ও মুসলিম)

শিরক থেকে মুক্তি: তাওহীদ মানুষকে শিরক থেকে মুক্তি দেয় এবং আল্লাহ্‌ তাআলা’র দিকে সম্পূর্ণ মনোনিবেশ করতে সহায়তা করে।

তাওহীদ ভেঙে ফেলা:

কিছু বিষয় আছে যা তাওহীদকে নষ্ট করতে পারে, যেমন:

শিরক: আল্লাহ্‌ ছাড়া অন্য কাউকে উপাসনা করা বা সাহায্য চাওয়া।

আল্লাহ্‌ ছাড়া অন্যের ক্ষমতা বিশ্বাস করা: যেমন মনে করা যে, কেউ আল্লাহ্‌ তাআলা’র চেয়ে অতিরিক্ত ক্ষমতাধর।

আল্লাহ্‌ তাআলা’র গুণাবলীকে বিকৃত করা: আল্লাহ্‌ তাআলা’র নাম বা গুণাবলীকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা।

এগুলি হল আল্লাহ্‌ তাআলা’র অস্তিত্ব এবং তাওহীদের মূল বিষয়বস্তু।

তাওহিদ আল্লাহ তাআলা হল এই বিশ্বাস যে আল্লাহ একমাত্র উপাসনার যোগ্য, তিনি সৃষ্টিকর্তা এবং পুরো বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ব্যবস্থাপক, এবং তাঁর কাছে নিখুঁত নাম ও গুণাবলী রয়েছে, যা কারো সাথে তুলনা করা যায় না। এই তাওহিদ তিনটি দিকের মধ্যে প্রকাশিত হয়: তাওহিদে রুবুবিয়াহ (আল্লাহর একক সৃষ্টির ও পরিচালনার ক্ষমতা), তাওহিদে উলুহিয়াহ (আল্লাহর একক উপাসনা), এবং তাওহিদে আসমা ওয়াস সিফাত (আল্লাহর সম্পূর্ণ নাম ও গুণাবলী যা অন্য কিছুতে নেই)।

তাওহিদে হাকেমিয়া হল তাওহিদের একটি দিক, যা বলে যে আল্লাহ তাআলা একমাত্র শাসক, এবং তাঁরই বিধান মেনে চলা উচিত সব শাস্ত্রীয় সিদ্ধান্তে, যেমন বিশ্বাস, উপাসনা, সামাজিক সম্পর্ক এবং অন্যান্য সব ক্ষেত্রে। এর মানে হল যে আল্লাহই একমাত্র আইন প্রণেতা, এবং মানুষের পক্ষে আল্লাহর আইন ছাড়া কিছু প্রণয়ন বা প্রচলন করা বৈধ নয়।

তাওহিদে হাকেমিয়ার সংজ্ঞা:
তাওহিদে হাকেমিয়া হল পূর্ণ বিশ্বাস যে জীবনের সব আইন শুধুমাত্র আল্লাহ তাআলার থেকেই আসতে হবে, এবং কোনো ব্যক্তি, রাষ্ট্র বা সরকার এমন কোনো আইন প্রণয়ন করতে পারে না যা ইসলামী শরিয়তের বিরুদ্ধে যায়।

কুরআন থেকে প্রমাণ:

১. কুরআন:

“إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ…” (আল-আন’আম: ৫৭)
এই আয়াতে বলা হচ্ছে যে জীবনের প্রকৃত শাসন আল্লাহরই, এবং কাউকে আল্লাহর ইচ্ছার বিপরীতে কোনো আইন প্রণয়ন করার অধিকার নেই।

“وَمَن لَّمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنزَلَ اللَّهُ فَأُو۟لَـٰٓئِكَ هُمُ ٱلْكَٰفِرُونَ” (আল-মায়েদা: ৪৪)
এই আয়াতে বলা হচ্ছে যে যারা আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী বিচার করেন না, তারা কাফির, এবং এটি তাওহিদে হাকেমিয়ার গুরুত্বকে ব্যাখ্যা করে।

২. হাদীস:

নবী (সাঃ) বলেছেন:
“যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রসূলকে তার মধ্যে যেসব বিরোধ আছে, সেগুলোর সিদ্ধান্ত হিসেবে গ্রহণ করে, সে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের শাসন মেনে নিয়েছে; আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রসূলকে তার মাঝে কোনো বিরোধ সমাধানে শাসক হিসেবে গ্রহণ করেনি, সে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের অধিকারকে অস্বীকার করেছে।”
(মুসলিম)

আজকের দিনে তাওহিদে হাকেমিয়ার প্রয়োজনীয়তা:

১. বৈষয়িক আইন প্রতিস্থাপন: আধুনিক যুগে আমরা দেখি যে অনেক দেশ মানব তৈরি আইন বা সেকুলার আইন গ্রহণ করেছে যা ইসলামী শরিয়তের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। যেমন পারিবারিক আইন, অর্থনীতি, শাস্তি ও নাগরিক অধিকার সম্পর্কিত আইন যদি ইসলামের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়, তবে এর ফলে সমাজে অস্থিরতা, পাপাচার এবং ইসলামী মূল্যবোধের লঙ্ঘন হতে পারে। এজন্য তাওহিদে হাকেমিয়ার দাবি করা প্রয়োজন যাতে ইসলামী শরিয়ত জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়।

২. সেকুলারিজমের বিরুদ্ধে লড়াই: অনেক দেশে সেকুলারিজমের ধারণা চালু আছে, যা ধর্ম ও রাষ্ট্রের আলাদাীকরণের পক্ষে, এবং তারা শাসনে ইসলামী শরিয়তকে মেনে নিতে চায় না। এই পরিস্থিতিতে তাওহিদে হাকেমিয়া দাবি করা জরুরি, যাতে ইসলামী আইন রাষ্ট্রীয় আইন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

৩. ঈশ্বরীয় শাসনের প্রতি বিশ্বাসের জোরালোতা: বর্তমানে, যখন কিছু আন্তর্জাতিক শক্তি ইসলামী শাসনকে প্রভাবিত করতে চায়, তাওহিদে হাকেমিয়া নিশ্চিত করে যে আল্লাহ তাআলাই একমাত্র সবার উপর সর্বোচ্চ শাসক, এবং কোন রাষ্ট্র বা সরকার ইসলামী শাসনের বিরুদ্ধে আইন প্রণয়ন করতে পারে না।

তাওহিদে হাকেমিয়ার বিরোধিতা:

১. আধুনিকতা ও মুক্তবাদের দাবি: কিছু মানুষ মনে করেন যে ইসলামী শরিয়ত বাস্তবায়ন করলে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে, এবং তারা মনে করেন ইসলামী শাসন অযৌক্তিক বা পুরনো যুগের বিষয়।

২. রাজনৈতিক বিরোধিতা: অনেক মুসলিম দেশে, কিছু সরকার ইসলামী শরিয়ত থেকে সরে গিয়ে সেকুলার বা মানবিক আইন গ্রহণ করেছে, যা উপনিবেশিক প্রভাব বা আন্তর্জাতিক চাপের ফলস্বরূপ হতে পারে।

৩. আর্থিক ও সামাজিক চ্যালেঞ্জ: অনেকের মতে, ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কিছু অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যা তৈরি করতে পারে, যেমন সুদের বিরুদ্ধে লড়াই করা বা শাস্তির বিধান।

তাওহিদে হাকেমিয়া হল ইসলামের একটি মৌলিক ধারণা, যা বলে যে আল্লাহ তাআলাই একমাত্র শাসক এবং তাঁরই আইন সকল ক্ষেত্রে অনুসরণ করা উচিত। এই ধারণা আধুনিক যুগে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যখন নানা ধরনের আইন ও শাসন ব্যবস্থা ইসলামী শরিয়তের বিপরীতে প্রয়োগ হচ্ছে। তাওহিদে হাকেমিয়া ইসলামী সমাজ ও মূল্যবোধ রক্ষার জন্য অপরিহার্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *