ইমানের স্তম্ভ (أركان الإيمان) ছয়টি, যা রাসূলুল্লাহ ﷺ হাদিসে জিবরাঈল (عليه السلام)-এ স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন।
عَنْ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ (رضي الله عنه) قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ:
“الإيمان أن تؤمن بالله، وملائكته، وكتبه، ورسله، واليوم الآخر، وتؤمن بالقدر خيره وشره.”
(মুসলিম, হাদিস: ৮)
অর্থ: ইমান হলো, তুমি আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতাগণ, তাঁর কিতাবসমূহ, তাঁর রাসূলগণ, কিয়ামত দিবস এবং তাকদির—চাই তা ভালো হোক বা মন্দ হোক—এগুলোর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে।
এই ছয়টি বিষয়কে বিশ্বাস করা ছাড়া কেউ প্রকৃত মুমিন হতে পারে না। নিম্নে প্রতিটি স্তম্ভ বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো।
১. আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস (الإيمان بالله)
১.১ আল্লাহর অস্তিত্বের প্রতি বিশ্বাস
আল্লাহর অস্তিত্বের প্রমাণ কুরআন, সুন্নাহ, ফিতরাত (প্রাকৃতিক জ্ঞান) এবং যুক্তির মাধ্যমে স্পষ্ট।
وَفِي الْأَرْضِ آيَاتٌ لِلْمُوقِنِينَ وَفِي أَنفُسِكُمْ أَفَلَا تُبْصِرُونَ
(সুরা আয-যারিয়াত: ২০-২১)
অর্থ: নিশ্চিত বিশ্বাসীদের জন্য পৃথিবীতে বহু নিদর্শন রয়েছে, আর তোমাদের নিজেদের মধ্যেও (আল্লাহর নিদর্শন রয়েছে); তবুও কি তোমরা দেখবে না?
১.২ তাওহীদের প্রতি বিশ্বাস
আল্লাহর একত্ববাদ তিনটি অংশে বিভক্ত:
তাওহীদুর রুবুবিয়্যাহ (توحيد الربوبية) – আল্লাহই একমাত্র সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা ও পরিচালনাকারী।
তাওহীদুল উলুহিয়্যাহ (توحيد الألوهية) – একমাত্র আল্লাহই ইবাদতের উপযুক্ত।
তাওহীদুল আসমা ওয়াস-সিফাত (توحيد الأسماء والصفات) – আল্লাহর নাম ও গুণাবলিকে কুরআন ও সুন্নাহ অনুসারে বিশ্বাস করা।
২. ফেরেশতাদের প্রতি বিশ্বাস (الإيمان بالملائكة)
২.১ ফেরেশতাদের পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য
ফেরেশতারা আল্লাহর নূর থেকে সৃষ্ট এবং তারা সর্বদা আল্লাহর আদেশ পালন করেন।
لَا يَعْصُونَ اللَّهَ مَا أَمَرَهُمْ وَيَفْعَلُونَ مَا يُؤْمَرُونَ
(সুরা আত-তাহরিম: ৬)
অর্থ: তারা আল্লাহর আদেশ অমান্য করে না এবং যা আদেশ করা হয়, তা সম্পাদন করে।
৩. কিতাবসমূহের প্রতি বিশ্বাস (الإيمان بالكتب)
৩.১ পূর্ববর্তী কিতাবসমূহ
আল্লাহ তাআলা বিভিন্ন যুগে নবীদের মাধ্যমে কিতাব নাজিল করেছেন।
إِنَّا أَنْزَلْنَا التَّوْرَاةَ فِيهَا هُدًى وَنُورٌ
(সুরা আল-মায়েদাহ: ৪৪)
অর্থ: নিশ্চয়ই আমি তাওরাত নাজিল করেছি, যাতে হেদায়াত ও আলো রয়েছে।
৩.২ কুরআনের শ্রেষ্ঠত্ব
কুরআন সর্বশেষ আসমানি কিতাব, যা কিয়ামত পর্যন্ত সংরক্ষিত থাকবে।
إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا ٱلذِّكْرَ وَإِنَّا لَهُۥ لَحَٰفِظُونَ
(সুরা আল-হিজর: ৯)
অর্থ: নিশ্চয়ই আমি কুরআন অবতীর্ণ করেছি এবং আমি নিজেই এর সংরক্ষক।
৪. রাসূলগণের প্রতি বিশ্বাস (الإيمان بالرسل)
৪.১ নবুয়ত ও রাসূলদের দায়িত্ব
আল্লাহ নবীদের মানবজাতির পথপ্রদর্শক হিসেবে প্রেরণ করেছেন।
وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ رَسُولٍ إِلَّا لِيُطَاعَ بِإِذْنِ اللَّهِ
(সুরা আন-নিসা: ৬৪)
অর্থ: আমি কোনো রাসূলকে পাঠাইনি, কিন্তু এ উদ্দেশ্যে যে, আল্লাহর অনুমতিক্রমে তার আদেশ পালন করা হবে।
৪.২ রাসূলুল্লাহ ﷺ সর্বশেষ নবী
মুহাম্মাদ ﷺ সর্বশেষ নবী ও রাসূল।
مَّا كَانَ مُحَمَّدٌ أَبَآ أَحَدٍۢ مِّن رِّجَالِكُمْ وَلَٰكِن رَّسُولَ اللَّهِ وَخَاتَمَ ٱلنَّبِيِّـۧنَ
(সুরা আল-আহযাব: ৪০)
অর্থ: মুহাম্মাদ তোমাদের কোনো পুরুষের পিতা নন; বরং তিনি আল্লাহর রাসূল ও নবীদের শেষ।
৫. কিয়ামতের প্রতি বিশ্বাস (الإيمان باليوم الآخر)
৫.১ মৃত্যুর পরবর্তী জীবন
মৃত্যুর পর প্রত্যেককে পুনরুত্থিত করা হবে এবং বিচার করা হবে।
وَمَا أَدْرَىٰكَ مَا يَوْمُ الدِّينِ ثُمَّ مَا أَدْرَىٰكَ مَا يَوْمُ الدِّينِ
(সুরা আল-ইনফিতার: ১৭-১৮)
অর্থ: তুমি কী জানো, বিচার দিবস কী? আবারও বলছি, তুমি কী জানো, বিচার দিবস কী?
৫.২ জান্নাত ও জাহান্নাম
আল্লাহ মুমিনদের জন্য জান্নাত এবং কাফেরদের জন্য জাহান্নাম নির্ধারণ করেছেন।
وَسِيقَ ٱلَّذِينَ ٱتَّقَوْا۟ رَبَّهُمْ إِلَى ٱلْجَنَّةِ زُمَرًا
(সুরা আয-যুমার: ৭৩)
অর্থ: যারা তাদের রবকে ভয় করেছিল, তাদেরকে দলে দলে জান্নাতে নিয়ে যাওয়া হবে।
৬. তাকদিরের প্রতি বিশ্বাস (الإيمان بالقدر)
৬.১ তাকদিরের সংজ্ঞা
তাকদির হলো, আল্লাহ যা নির্ধারণ করেছেন, তা অবশ্যম্ভাবী।
إِنَّا كُلَّ شَيْءٍ خَلَقْنَاهُ بِقَدَرٍ
(সুরা আল-কামার: ৪৯)
অর্থ: আমি প্রত্যেক বস্তু নির্ধারিত পরিমাণে সৃষ্টি করেছি।
৬.২ তাকদিরের স্তরসমূহ
তাকদিরের স্তরসমূহ ও তাদের দলিল
তাকদির বা পরিপূর্ণ নির্ধারণের বিশ্বাস ইসলামের অন্যতম মূল আকিদা। আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ-এর মতে, তাকদিরের চারটি স্তর রয়েছে:
- আল্লাহর পূর্বজ্ঞান (العلم)
- আল্লাহর লিখন (الكتابة)
- আল্লাহর ইচ্ছা (المشيئة)
- আল্লাহর সৃজনশীলতা (الخلق)
নিচে প্রতিটি স্তরের কুরআন ও সুন্নাহ থেকে দলিল উল্লেখ করা হলো।
১. আল্লাহর পূর্বজ্ঞান (العلم)
আল্লাহ অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সমস্ত কিছু সম্পর্কে পূর্ব থেকেই জানেন।
কুরআনের দলিল:
أَلَمْ تَعْلَمْ أَنَّ اللَّهَ يَعْلَمُ مَا فِي السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ ۗ إِنَّ ذَٰلِكَ فِي كِتَابٍ ۚ إِنَّ ذَٰلِكَ عَلَى اللَّهِ يَسِيرٌ
(سورة الحج: ٧٠)
অর্থ: তুমি কি জানো না যে, আল্লাহ আকাশ ও পৃথিবীর সমস্ত কিছু জানেন? নিশ্চয়ই এটি একটি কিতাবে লিপিবদ্ধ আছে এবং এটি আল্লাহর জন্য অত্যন্ত সহজ।
إِنَّ اللَّهَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ
(سورة المجادلة: ৭)
অর্থ: নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বজ্ঞ।
হাদিসের দলিল:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন:
“إِنَّ اللَّهَ تَعَالَى كَتَبَ مَقَادِيرَ الْخَلَائِقِ قَبْلَ أَنْ يَخْلُقَ السَّمَوَاتِ وَالأَرْضَ بِخَمْسِينَ أَلْفَ سَنَةٍ”
(মুসলিম, হাদিস: ২৬৫৩)
অর্থ: আল্লাহ আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করার পঞ্চাশ হাজার বছর আগে সমস্ত সৃষ্টির তাকদির লিখে রেখেছেন।
২. আল্লাহর লিখন (الكتابة)
আল্লাহ তার পূর্বজ্ঞান অনুযায়ী সবকিছু লাওহে মাহফুজে লিখে রেখেছেন।
কুরআনের দলিল:
مَا أَصَابَ مِنْ مُصِيبَةٍ فِي الْأَرْضِ وَلَا فِي أَنْفُسِكُمْ إِلَّا فِي كِتَابٍ مِنْ قَبْلِ أَنْ نَبْرَأَهَا ۚ إِنَّ ذَٰلِكَ عَلَى اللَّهِ يَسِيرٌ
(سورة الحديد: ২২)
অর্থ: পৃথিবীতে বা তোমাদের জীবনে কোনো বিপদ আসে না, যা আমি সৃষ্টি করার আগেই এক কিতাবে লিখে রাখিনি।
হাদিসের দলিল:
أَوَّلُ مَا خَلَقَ اللَّهُ الْقَلَمَ فَقَالَ لَهُ: اكْتُبْ، قَالَ: مَا أَكْتُبُ؟ قَالَ: اكْتُبْ مَا هُوَ كَائِنٌ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ
(আবু দাউদ, হাদিস: ৪৭০০; তিরমিজি, হাদিস: ২১৫৫)
অর্থ: আল্লাহ যখন কলম সৃষ্টি করলেন, তখন তাকে বললেন: ‘লিখ’। কলম বলল, ‘আমি কী লিখব?’ আল্লাহ বললেন, ‘কিয়ামত পর্যন্ত যা কিছু ঘটবে, তা লিখে রাখো।’
৩. আল্লাহর ইচ্ছা (المشيئة)
আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন, তাই ঘটে। তাঁর অনুমতি ছাড়া কিছুই ঘটে না।
কুরআনের দলিল:
وَمَا تَشَاءُونَ إِلَّا أَنْ يَشَاءَ اللَّهُ رَبُّ الْعَالَمِينَ
(سورة التكوير: ২৯)
অর্থ: তোমরা কিছুই ইচ্ছা করতে পারবে না, যদি না আল্লাহ, সমস্ত জগতের রব, তা ইচ্ছা করেন।
وَلَوْ شَاءَ اللَّهُ مَا اقْتَتَلُوا وَلَكِنَّ اللَّهَ يَفْعَلُ مَا يُرِيدُ
(سورة البقرة: ২৫৩)
অর্থ: আল্লাহ চাইলে তারা যুদ্ধ করত না, কিন্তু আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন, তাই করেন।
হাদিসের দলিল:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন:
“لَوْ اجْتَمَعَتِ الْأُمَّةُ عَلَى أَنْ يَنْفَعُوكَ بِشَيْءٍ لَمْ يَنْفَعُوكَ إِلَّا بِشَيْءٍ قَدْ كَتَبَهُ اللَّهُ لَكَ”
(তিরমিজি, হাদিস: ২৫১৬)
অর্থ: যদি সমগ্র উম্মত একত্র হয়ে তোমার উপকার করতে চায়, তবে তারা শুধুমাত্র তা-ই করতে পারবে, যা আল্লাহ তোমার জন্য লিখে রেখেছেন।
৪. আল্লাহর সৃজনশীলতা (الخلق)
আল্লাহ সকল সৃষ্টির স্রষ্টা এবং তিনিই সমস্ত কর্মের মালিক।
কুরআনের দলিল:
وَاللَّهُ خَلَقَكُمْ وَمَا تَعْمَلُونَ
(سورة الصافات: ৯৬)
অর্থ: আল্লাহই তোমাদের সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদের কর্মও তিনিই সৃষ্টি করেন।
اللَّهُ خَالِقُ كُلِّ شَيْءٍ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ وَكِيلٌ
(سورة الزمر: ৬২)
অর্থ: আল্লাহই সবকিছুর স্রষ্টা এবং তিনি সর্বকিছুর উপর দায়িত্বশীল।
হাদিসের দলিল:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন:
“إِنَّ اللَّهَ صَانِعُ كُلِّ صَانِعٍ وَصَنْعَتِهِ”
(বুখারি, আদাবুল মুফরাদ: ৭৯৮)
অর্থ: আল্লাহ সমস্ত কারিগর এবং তার কারিগরিরও স্রষ্টা